শুক্রবার, ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০১:০৩ পূর্বাহ্ন
নেত্রকোনার প্রত্যন্ত গ্রামের এক সাধারণ যুবক, কোনও উচ্চশিক্ষা নেই, নেই পেশাদার ক্যামেরা বা উন্নত প্রযুক্তি। হাতে শুধুই কাঠ কাটার সরঞ্জাম, বুকভরা কষ্ট আর মোবাইল ক্যামেরা। এই সামান্য দিয়েই যিনি ছুঁয়ে যাচ্ছেন লাখো মানুষের হৃদয়, তিনিই রিপন মিয়া। একসময়ের ‘ক্রিঞ্জ’ কনটেন্ট নির্মাতা হিসেবে যাকে নিয়ে হাসাহাসি হত, আজ তার কনটেন্ট দেখা হয় কোটি কোটি বার।
একটা সময় ছিল, যখন প্রেমে ব্যর্থ হয়ে অনেকে জীবনকে শেষ করে দেয়। কিন্তু রিপন সেই দলে ছিলেন না। তিনি ব্যর্থ প্রেমকে রূপ দিলেন সৃজনশীলতায়, সেই শুরু তার অনলাইন যাত্রার।
প্রেম ভাঙে, মন ভাঙেনি
২০১৬ সালের দিকে কৈশোরের এক প্রেম ভেঙে গেলে রিপনের মনে ছিল প্রচণ্ড কষ্ট। তখনই নিজের কষ্টের কথাগুলো ছন্দে ছন্দে বলতে শুরু করেন। ‘বন্ধু তুমি একা হলে, আমায় দিও ডাক, তোমার সঙ্গে গল্প করব আমি সারারাত’ এই লাইনটি ছিল তার প্রথম ভিডিওর অংশ। ভিডিওটি তখন ভাইরাল হয়, তবে সেই ভাইরালতা কাজে লাগাতে পারেননি।
নিজের সরল উপস্থাপনা আর নড়বড়ে মোবাইল ভিডিও দিয়ে প্রথমদিকে তার কাজকে অনেকে তাচ্ছিল্য করত। কেউ কেউ বলত ‘ক্রিঞ্জ’, কেউ বলত ‘নকল কবি’। কিন্তু রিপনের ভেতরের কবি চুপ থাকেনি।
‘কাঠমিস্ত্রি কাম শিখামু, রোজ ৫০০ টেকা পাইবা’
২০২৩ সালে এইচএসসি পরীক্ষার্থীদের অটোপাশের দাবির প্রতিবাদে একটি ভিডিও পোস্ট করে আবার ভাইরাল হন তিনি। বলেছিলেন, ‘তোমরা যদি পরীক্ষা না দিতে চাও, আমার কাছে আইসা কাঠমিস্ত্রির কাম শিখা, রোজ ৫০০ টাকা রোজগার করবা। এটাই বাস্তব!’
এই ভিডিওটি যেন এক নতুন রিপনের জন্ম দেয়, যিনি শুধু ছন্দ বলার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নন, বরং সমাজের নানা অসঙ্গতি নিয়ে হাস্যরসের মাধ্যমে কথা বলেন। তার সরল ভাষা, আঞ্চলিক টোন আর বাস্তবতা মেশানো এই ভিডিওটি রাতারাতি নেটিজেনদের হৃদয় জয় করে নেয়।
‘রিপন ২.০’ একটা নতুন অধ্যায়
সেই যে এক সময় ভাইরাল হয়েছিলেন, তারপর বারবার তার অ্যাকাউন্ট হ্যাক হয়েছে। পেজ হারিয়েছেন, কনটেন্ট চুরি হয়েছে, কিন্তু হাল ছাড়েননি। একসময় এতটাই হতাশ হয়ে পড়েছিলেন যে ভিডিও বানানো বন্ধ করে দেন। পুরোদমে কাঠমিস্ত্রির কাজ শুরু করেন, ঘাম ঝরিয়ে কাটান দিন।
‘একটা সময় ভিডিও বানানোর মতো ফোনও ছিল না। সবাই আমার কনটেন্ট থেকে টাকা বানায়, আর আমি কিছুই পাই না’, কথাগুলো বলেছিলেন এক সাক্ষাৎকারে।
তবে পরে এক মিডিয়া ম্যানেজারের সঙ্গে পরিচয় হয়, যিনি রিপনকে প্রফেশনালি গাইড করেন। এখন তারা একসঙ্গে কাজ করেন, এবং রিপন ধীরে ধীরে শুরু করেন নিজের প্ল্যাটফর্ম থেকে উপার্জন।
রিপনের কনটেন্ট: গ্ল্যামার নয়, গ্রামের আলো-বাতাসে ভরা
রিপনের কনটেন্টে নেই কোনো স্টুডিও, নেই ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক বা স্পেশাল এফেক্ট। তবু তার ভিডিওতে যা আছে, তা হলো বাস্তবতা। তিনি এখনও সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে সাইকেল চালিয়ে কাজে যান। গরমে ঘামে ভিজে রান্না করেন, কাঠ কাটেন, আর মাঝে মাঝে বলেন, ‘তোমরা গরমে একটু হাঁটলেই অস্থির হয়ে যাও, আর আমাদের মা-বোনেরা এই গরমে রান্না করে। কখনও কি তাদের কষ্ট ভেবে দেখছ?’
তিনি একেবারে মাটির মানুষ। এখনকার ভিডিওগুলোতে আগের সেই প্রেমময় ছন্দ কম, বরং উঠে আসে জীবনের নানা পাঠ, চাকরি না পাওয়া শিক্ষিত যুবকদের জন্য কাজ শেখার পরামর্শ, যৌতুক বিরোধী বার্তা, বা দুর্নীতির প্রতিবাদ।
ছন্দ এখনো থেমে যায়নি
তবে একেবারে ছন্দ ছাড়েননি রিপন। মাঝে মাঝে হেসে বলেন, ‘বন্ধু তুমি পাখি হলে, আমি হব নীড়, তোমার আমার প্রেম দেখতে লেগে যাবে ভিড়’ অথবা ‘সকাল সকাল তোমাকে একটা মেসেজ ড্রপ করতে চাই, আই লাভ ইউ।’
এই চেনা হাসি, চেনা ছন্দ আর আন্তরিক উপস্থাপনাই রিপন মিয়াকে আলাদা করে তোলে অন্য সব কন্টেন্ট ক্রিয়েটরের থেকে।
টাকা এলেও জীবন বদলায়নি
আজ তার ফেসবুকে দুইটি জনপ্রিয় পেজ ‘খাদক রিপন’ এবং ‘রিপন মিয়া’। ইউটিউব, ইনস্টাগ্রাম, টিকটকে মিলিয়ে এক মিলিয়নেরও বেশি অনুসারী। এখন তিনি ভিডিও থেকে কিছু আয় করছেন ঠিকই, কিন্তু জীবনযাত্রা বদলায়নি।
তিনি বলেন, ‘আমি এখনো সেই জরাজীর্ণ বাড়িতেই থাকি, বাড়ির ভেতর দিয়ে কুকুর হাঁটে। আমরা গ্রামে মানুষ, কাজ ছাড়া থাকতে পারি না।’
তাঁর ভিডিওতে এখনও দেখা যায়, শহরের কোনো উঁচু বিল্ডিংয়ের দিকে তাকিয়ে বিস্মিত চোখে তাকিয়ে আছেন। যেন এই প্রথম দেখছেন এমন কিছু। এটাই তার অনন্যতা, তিনি অভিনয় করেন না, তিনি কেবল রিপন।
তিনি সম্প্রতি একটা ভিডিও বার্তায় বলেন, ‘আমি তো লেখাপড়া জানি না, আপনারা তো জানেন ই সেটা, কিন্তু আমি যখন কোনো রেস্টুরেন্টে যাই তখন রেস্টুরেন্টে বলতে থাকে, কী খাবেন স্যার? কী খাবেন বলেন! বুঝতে পারছেন, আমাকে স্যার ডাকে, এটা ভাবতেই তো আমার আনন্দ লাগে। আমি এটা উপভোগ করি।’
একটি গল্প, একটি বার্তা
রিপন মিয়ার জীবন ও সৃষ্টিশীলতার গল্প যেন এক অন্যরকম অনুপ্রেরণা। তিনি প্রমাণ করেছেন, সফলতা মানেই গ্ল্যামার নয়। গল্প, সত্যতা, আর নিজের প্রতি বিশ্বাস থাকলে কেউই থেমে থাকে না।
আজকের ডিজিটাল দুনিয়ায় রিপন হয়ে উঠেছেন এক ব্যতিক্রমী প্রতিচ্ছবি, যিনি বাণিজ্যিক ফর্মুলা ছাড়াই ভালোবাসা কুড়াচ্ছেন। তার মতো মানুষ আমাদের মনে করিয়ে দেন, জীবনের ছন্দ গড়ে ওঠে নিজের ভাঙা টুকরোগুলো জুড়ে নিয়েই।
ক্যামেরার লেন্সে ধরা পড়ে অনেক কিছু। কিন্তু রিপনের ভিডিওতে ধরা পড়ে মন। আর সেই মনই দিন দিন জয় করে নিচ্ছেন তিনি।
Leave a Reply